স্পেনে উমাইয়া শাসন (The Umayyad Rule in Spain)
মহানবি (স.)-এর ইসলাম প্রচারের আদর্শকে ধারণ করে পরবর্তী খলিফাগণ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেছেন। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা)-এর শাসনামলে ইসলামি সাম্রাজ্য বিস্তারের শুভ সূচনা ঘটে এবং উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদের রাজত্বকালে (৭০৫-৭১৫) তা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশে বিস্তৃতি লাভ করে।
Tarikh Bin Zihad |
আল ওয়ালিদের সেনাধ্যক্ষ কুতায়বা বিন মুসলিম এশিয়া মাইনর এবং সেনাপতি মুহাম্মদ কাসিম সিন্ধু বিজয় করেন। একই সময়ে পশ্চিম রণাঙ্গনে ইসলামের ঝাণ্ডা উত্তোলন করেন মুসা বিন নুসায়ের। তিনি সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদের সাথে একত্র হয়ে ইউরোপের দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দেশ স্পেনকে মুসলমানদের পতাকাতলে সমাসীন করেন।
আইবেরীয় উপদ্বীপ নামে পরিচিত এ অঞ্চলটিতে মুসলমানগণ ৭৮০ বছর (৭১১-১৪৯২ খ্রি.) ধরে শাসন করেন। প্রথমে উমাইয়া ও পরে আব্বাসি প্রদেশ এবং আরো পরে উমাইয়া আমিরাত ও খিলাফত প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে স্পেনে মুসলমানদের এ শাসনব্যবস্থা চলে। আলোচ্য অধ্যায়ে স্পেনে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মুসলমানদের উত্থান, শাসনব্যবস্থা, পতন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিবরণ উপস্থাপন করা হয়েছে।
মুসলমানদের স্পেন বিজয় (Conquest of Spain by the Muslims)
স্পেনের পরিচিতি ও ভৌগোলিক অবস্থান:
অক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের দেশ স্পেন। এটি আইবেরীয় উপদ্বীপে অবস্থিত। স্পেনের দক্ষিণ ও পূর্ব সীমান্ত ভূমধ্যসাগর। পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে পর্তুগাল এবং আটলান্টিক মহাসাগর। আর উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে পিরেনিজ পর্বতমালা এবং বিশ্বে উপসাগর। মুসলিম শাসনামলে দেশটি আন্দালোসিয়া নামে পরিচিত ছিল। এর বর্তমান সাংবিধানিক নাম Kingdom of Spain. মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে স্পেনের রাজধানী ছিল টলেডো, মুসলিম শাসনামলে কর্ডোতা এবং বর্তমানে এর রাজধানী মাদ্রিদ।
মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে স্পেনের অবস্থা
উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদের সময় আরব মুসলমানগণ স্পেন জয় করে। স্পেন বিজয়ী সেনাপতির নাম তারিক বিন জিয়াদ। তিনি ওয়ালিদের উত্তর আফ্রিকার শাসনকর্তা মুসাবিন নুসায়েরের নির্দেশে স্পেন আক্রমণ ও জয় করেন। ঐতিহাসিকগণ আরব মুসলমানদের স্পেন বিজয়কে একটি সুদূরপ্রসারী ও তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি একে ‘মধ্যযুগীয় সমর ইতিহাসে এক অপূর্বস্থান দখলকারী ঘটনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের পিছনে নানা কারণ ছিল। তবে এ সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে স্পেনের তৎকালীন রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
রাজনৈতিক অবস্থা: মুসলমানদের আগমনের পূর্বে স্পেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল এবং শাসনকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও কলহ বিদ্যমান ছিল। সে সময়ে স্পেনের রাজা ছিলেন গথিক বংশের খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী রডারিক। উচ্চাভিলাষী ও অত্যাচারী রডারিক ন্যায়সংগত রাজা উইটিজাকে পদচ্যুত ও হত্যা করে বলপূর্বক সিংহাসন অধিকার করেন। সাম্রাজ্যের অধীন রাষ্ট্রগুলো নামেমাত্র তার বশ্যতা স্বীকার করে কর প্রদান করত। এসব অঞ্চলের শাসনকর্তারা পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহে লিখ ছিল।
সামাজিক অবস্থা: সে সময়ে স্পেনের সামাজিক অবস্থা অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক ছিল। সমাজে তিন শ্রেণির লোক বসবাস করত। যথা-১। সুবিধাভোগী অভিজাত সম্প্রদায়। এ শ্রেণির মধ্যে ছিলেন রাজা, অমাত্যবর্গ, যাজক ও সামন্ত রাজাগণ । ২। নিম্ন শ্রেণিভুক্ত কৃষক এবং ৩। ক্রীতদাস। অভিজাত সম্প্রদায় আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করত। মধ্য শ্রেণির লোকদের সকল প্রকার কর প্রদান করতে হতো। ফলে তারা ধ্বংস ও দৈন্যের কবলে পড়ত। কৃষকদের নিজস্ব কোনো জমি ছিল না। ভূমিদাস ও ব্যক্তিগত দাস হিসেবে পরিচিত ক্রীতদাসদের মানুষ বলে মনে করা হতো না। ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, ‘ভূমিদাস হোক বা ক্রীতদাস হোক, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাদের স্বাধীনতা লাভ বা মুক্ত সূর্যালোক ভোগ করার কোনো অধিকার ছিল না। ১
অর্থনৈতিক অবস্থা: স্পেনের অর্থনৈতিক অবস্থাও হতাশাব্যঞ্জক ছিল। রাষ্ট্রীয় অর্থের যথেষ্ট অপব্যবহার বৈষম্যমূলক সম্পদ বণ্টননীতি এবং নিবর্তনমূলক রাজস্ব নির্ধারণ ইত্যাদি নানা কারণে অভিজাত সম্প্রদায় ছাড়া মধ্য ও নিম্ন শ্রেণির লোকেরা অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত জীবনযাপন করত। তাদের ওপর অতিরিক্ত কর ধার্য করা হতো। শিল্পের ওপরও অতিরিক্ত শুল্ক ধার্যের কারণে ব্যবসা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কৃষি ব্যবস্থাও দুর্দশার মুখে পড়ে। এক কথায় সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে।
ধর্মীয় অবস্থা: দেশে সে সময় ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল না। খ্রিষ্টান ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণযোগ্য মনে করা হতো না। ইহুদিদেরকে হয় খ্রিষ্টান না হয় সেবাদাস হয়ে জীবনযাপন করতে হতো। এস.এম ইমাম উদ্দিনের ভাষ্যমতে, ৬১২ থেকে ৬২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে স্পেনে ৯০ হাজার ইহুদিকে বলপূর্বক খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করা হয়েছিল।
স্পেন বিজয়ের কারণ
আরব মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের পিছনে নানা কারণ ছিল যেমন:
রাজা রডারিকের কুশাসন ও জনদুর্গতি: এ সময় স্পেনের রাজা ছিলেন গথিক রাজ বংশীয় রডারিক। তিনি ছিলেন প্রজা নিপীড়ক ও দুরাচারী শাসক। তার নিবর্তনমূলক কুশাসনে অতিষ্ঠ ও চরম দৈন্যাবস্থায় নিপতিত শাসিত শ্রেণির সার্ফ, ক্রীতদাস এবং ইহুদি সম্প্রদায় মুক্তির স্বাদ আস্বাদনের জন্য অধীরভাবে প্রহর গুনছিল। এ সময় জিব্রালটারের দক্ষিণপাশের আরব মুসলিম শাসনাধীনে উত্তর আফ্রিকায় সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সংবাদ তাদের কানে এসে পৌছেছিল । ঐতিহাসিকদের তথ্যানুযায়ী স্পেনের নিপীড়িত জনতা তখন তাদের মুক্তির জন্য মুসা বিন নুসায়েরের দ্বারস্থ হলে তিনি তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে যান।
কাউন্ট জুলিয়ানের আমন্ত্রণ: আরব মুসলিম শাসিত আফ্রিকার অদূরবর্তী স্পেনিশ দ্বীপ সিউটা। এর শাসনকর্তা ছিলেন কাউন্ট জুলিয়ান। তিনি ছিলেন রাজা রডারিক কর্তৃক বলপূর্বক ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত স্পেনের রাজা উইটিজার জামাতা। শ্বশুর উইটিজাকে সিংহাসনচ্যুত করে ক্ষমতা দখলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজা রডারিকের সাথে কাউন্ট জুলিয়ানের বৈরী সম্পর্ক ছিল।
তদুপরি দেশাচার অনুযায়ী রাজকীয় আচার-আচরণ শেখার জন্য স্পেনের রাজদরবারে প্রেরিত জুলিয়ানের কন্যা ফ্লোরিন্ডাকে রডারিক শ্লীলতাহানি ঘটালে উভয়ের মধ্যকার শত্রুতা চরম আকার ধারণ করে। এমতাবস্থায় শ্বশুর হত্যা ও কন্যার অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণার্থে কাউন্ট জুলিয়ান খলিফা আল ওয়ালিদের সেনাপতি ও পশ্চিমাঞ্চলীয় ইফরিকিয়ার শাসনকর্তা মুসা বিন নুসায়েরকে স্পেন আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানান ।
উমাইয়াদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি: খলিফা আল ওয়ালিদের শাসনামল ছিল উমাইয়া খিলাফতের সম্প্রসারণের যুগ। এ সময় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ পূর্বাঞ্চলে এবং কুতায়বা বিন মুসলিম মধ্য এশিয়ায় উমাইয়া অধিকার সম্প্রসারণ করে খ্যাতি লাভ করেন। আফ্রিকার উমাইয়া গভর্নর মুসা বিন নুসায়েরও স্পেন জয় করে নিজের খ্যাতি বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন।
স্পেন আক্রমণের ঘটনা
কাউন্ট জুলিয়ানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে উত্তর আফ্রিকার উমাইয়া গভর্নর মুসা খলিফা আল ওয়ালিদের অনুমতিক্রমে ৭১০ খ্রিস্টাব্দে তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে ৪০০ সৈন্য ও ১০০ অশ্বসহ চারখানা রণতরী দিয়ে স্পেনে একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠান।
পর্যবেক্ষক দলটির বিবরণ অনুকূলে হওয়ায় মুসা ৭,০০০ সৈন্যসহ সেনানায়ক তারিক বিন জিয়াদকে ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনে প্রেরণ করেন। তারিক জিব্রালটার প্রণালী (ভূমধ্যসাগর আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে সংযোগস্থাপনকারী) পাড়ি দিয়ে স্পেনের পার্বত্য এলাকায় অবতরণ করেন।
তারিকের অবতরণ করা পর্বত এখনো জাবাল আত-তারিক নামে সুপরিচিত। রাজা রডারিকের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশপাল থিওডমিরকে পরাজিত করে তারিক আরও সম্মুখভাগে অগ্রসর হন এবং রাজধানী টলেডোর দিকে এগিয়ে চলেন। রাজা রডারিক মুসলিম বাহিনী কর্তৃক আক্রমণের সংবাদ পাওয়া মাত্র সর্বমোট ১ লাখ ২০ হাজার সৈন্যসহ গোয়াডিলেট (গোয়াদাল) কুইভার নদীর তীরে মেডিনা প্রিডোনিয়া রণক্ষেত্রে মুসলিম বাহিনীর সম্মুখীন হন।
বহুসংখ্যক সৈন্য নিয়ে সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধের পর ৭১১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে রডারিক পরাজিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় গোয়াডিলেট নদীর পানিতে ডুবে প্রাণ হারান। এরপর মুসলিম বাহিনী মালাগা, গ্রানাডা, কর্ডোভা এবং টলেডো দখল করেন। তারিকের এ গৌরবময় বিজয়ে মুসা ঈর্ষান্বিত হয়ে তিনি নতুন অভিযান পরিচালনা করে সেফিল, মেরিডা, কারমোনা প্রভৃতি শহর জয় করেন। এভাবে ৭১২ হতে ৭১৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত খ্রিষ্টান অধ্যুষিত স্পেন মুসলিম সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। উত্তরে পিরেনিজ পর্বত থেকে দক্ষিণে জিব্রালটার প্রণালী পর্যন্ত সমগ্র স্পেন ইসলামি শাসনের পতাকাতলে আসে।
স্পেন বিজয়ের ফলাফল
খলিফা ওয়ালিদের স্পেন বিজয় ইসলামের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। স্পেনের রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের ওপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
রাজনৈতিক: স্পেন বিজয়ের ফলে ইউরোপে ইসলাম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেভিলকে রাজধানী করে মুসলমান শাসকগণ স্পেনে একটি সুনিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ইতোপূর্বে স্পেনের রাজনীতিতে রাজা, ধর্মযাজক এবং সামন্ত অভিজাত শ্রেণির যে প্রভাব বলয় তৈরি হয়েছিল নতুন প্রশাসনের আওতায় তার বিলুপ্তি ঘটে। শোষিত নিপীড়িত সাধারণ জনতা মুক্তির আস্বাদন লাভ করে।
সামাজিক: আরবদের স্পেন বিজয় সেখানকার সামাজিক জীবনে এক বিপ্লব ঘটায়। সমাজজীবনে অভিজাত ও যাজকশ্রেণির প্রাধান্যের অবসান ঘটে। সমাজজীবন থেকে সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্যের অবসান হয়। ক্রীতদাসদের মুক্তি দিয়ে তাদের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়। ফলে অনেকেই স্বাধীন পেশা ও নাগরিক জীবনে ফিরে যায়। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ফলে সুবিধাভোগী অভিজাত শ্রেণির দৌরাত্ম্যের অবসান ঘটে।
সমাজজীবনে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের জয় নিশ্চিত হয়। অর্থনৈতিক: আরব বিজয়ের প্রভাবে স্পেনের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। মুসলিম শাসকগণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের প্রসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কৃষির উন্নতি বিধান করা হয়। ভূমিতে ব্যক্তি মালিকানা স্বীকৃত হওয়ায় কৃষক সমাজ কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে মনোযোগী হয়। নিম্নশ্রেণির লোকদের করভার লাঘব করা হয়। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে স্পেন ক্রমশ অর্থনৈতিক পথে অগ্রসর হয়।
ধর্মীয়: আরব বিজয়ের ফলে স্পেনের ধর্মীয় ক্ষেত্রেও পরিবর্তনের সুবাতাস প্রবাহিত হয়। বলপূর্বক ধর্মান্তকরণের কু-রীতির অবসান ঘটে। ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলমানরা স্বাধীনভাবে স্ব স্ব ধর্ম ও আচার অনুষ্ঠান পালনের সুযোগ লাভ করে। জান-মালের নিরাপত্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে কেবল জিজিয়া নামক এক প্রকার কর আদায় করা হয়। মুসলিম শাসমিলে নতুন গির্জা নির্মাণে কোনো বাধা প্রদান করা হয়নি এবং উপাসনার জন্য গির্জায় ঘণ্টা বাজানোতেও কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। সর্বত্র ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বিরাজ করে। নবতর পরিস্থিতিতে অনেকেই ইসলামের সুমহান আদর্শে উদ্দীপ্ত হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে।
সাংস্কৃতিক: উমাইয়াদের স্পেন বিজয়ের সাংস্কৃতিক ফলাফল ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। মুসলিম শাসকদের উদার পৃষ্ঠপোষকতায় স্পেন সমকালীন ইউরোপের উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। বলা হয় যে, মুসলিম স্পেন ইউরোপকে অজ্ঞতার অন্ধকার হতে আলোর সন্ধান দেয়।
ফলে ইউরোপে নবজাগরণের সূচনা হয়। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, পঞ্চদশ শতকে ইউরোপে যে রেনেসাঁ বা জাগরণ ঘটে তার মূলে মুসলিম স্পেনের ভূমিকা রয়েছে। মুসলিম স্পেনের রাজধানী কর্ডোভা ইউরোপের বাতিঘর নামে খ্যাতি লাভ করেছিল। ঐতিহাসিক স্টেনলি বলেন, “মুরগণ (আরব মুসলমান) প্রতিষ্ঠিত কর্ডোভা রাজ্য মধ্যযুগের এক পরম বিস্ময়। সমগ্র ইউরোপ যখন বর্বর, অজ্ঞতা ও দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত, এ রাজ্য তখন পাশ্চত্যের সম্মুখে উজ্জ্বল আলো বিকিরণকারী জ্ঞান ও সভ্যতার মশাল তুলে ধরেছিল।”
উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইসলামি বিশ্বের নেপোলিয়ন’ নামে খ্যাত খলিফা আল ওয়ালিদের রাজত্বকালে আরবদের স্পেন বিজয় ইতিহাসের এক চমকপ্রদ ঘটনা। সৈয়দ আমীর আলীর ভাষায়, “স্পেনে মুসলিম শাসন থেকে আধুনিক যুগের সরকারদের শিক্ষা গ্রহণ করার অনেক বিষয় আছে।” (Many modern governments might well take a lesson from the Moslem administration in Spain.)
দীর্ঘ প্রায় আটশ বছর পর্যন্ত মুসলমানরা গৌরবের সাথে স্পেন শাসন করে।” ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনে মুসলিম শাসনের চূড়ান্ত অবসান ঘটে।
মুসলমানদের সহজ বিজয়ের কারণ: আরব মুসলমানদের সহজে স্পেন বিজয়ের পেছনে নানা কারণ ছিল। যেমন প্রথমত: স্পেনের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, সামাজিক দুরবস্থা এবং ধর্মীয় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি আরবদের বিজয়কে সহজ করেছিল। দ্বিতীয়ত: রাজা রডারিকের প্রতি অসন্তুষ্ট টিউটর গভর্ণর কাউন্ট জুলিয়ানের সহযোগিতা
আরবদের সহজ বিজয়ের অন্যতম কারণ ছিল। তৃতীয়ত: স্পেনিশ বাহিনীর দুর্বলতা এবং রাজার প্রতি তাদের আনুগত্যের অভাব রডারিকের পরাজয় এবং আরবদের সহজ বিজয়ের অন্যতম কারণ। সর্বোপরি মুসা বিন নুসায়ের ও তারিক বিন জিয়াদের যোগ্য নেতৃত্ব, মুসলমানদের বিজয় অর্জনের জেহাদি মনোভাব এবং তাদের উন্নত সমরাস্ত্র এ বিজয়কে সহজ করেছিল।
👉 একক কাজ: মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের ফলাফল উল্লেখ কর।
Read MORE: উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি খিলাফত | Fatimid Khilafat in North Africa